শহর ও সহিষ্ণুতা
১।
একটা ফ্লাইওভার চিৎকার করে শাদা হয়ে গেল। কালিকামন্দিরের নিজস্ব ছাইভস্ম থেকে দু’টো স্পর্শ জেগে উঠল। আমি হাসতে থাকলাম, আর শূন্যতায় ভরা ম্যাজেন্টা লাইনের গতি বাড়ল। এভাবেই আকাশগঙ্গার কিনারে বারো হাজার বছর পর দেখা হবে।
হাওয়ায় বড় সামান্য হিমযুগ। মিথ্যে উরুসন্ধির গল্প আস্তে আস্তে শেষ করে আকাশের কালপুরুষ নিভে যাচ্ছে। ট্রেন থামতেই পুতুলের ঘরবাড়ির সামনে আমায় দাঁড় করিয়ে দিলেন বোলেস্ল প্রুস। চ্যালকোলিথ আঙুলের দাগ পড়ল মহানগরের মাংসাশী চৌকাঠে।
‘মাংসে ঝাল কতটা দেব?’ বাদামী চোখ তোলে বান্ধবী। মহাপ্রাণ ধ্বনি ডুবে যায়। অভিনয় বাড়িয়ে দেয় লোদী গার্ডেন থেকে উড়ে আসা অতর্কিত ধনেশ। ঠান্ডা মাংসের হাড় নিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি অন্ধকার হুমায়ুন সমাধিতে। তলপেটের ব্যথা সরে আসে মৃগশিরা নক্ষত্রে।
কাঁটাচামচের শব্দটা একটা নরম ফলের ওপর অপেক্ষা করছে। পথের সমস্ত শাখাপ্রশাখায় তীক্ষ্ণ তীরধনুক হাতে দাঁড়িয়েছেন শ্রীরাম। করিমসের উষ্ণ বিরিয়ানি পরিবেশন করতে করতে রজঃস্বলা বান্ধবী হাসেন ‘এই হিমযুগ যে কবে শেষ হবে…’
আমার হাসির শব্দ আটকে পড়ে পুরনো কেল্লায়। শরীরের ধারণা থেকে অনন্ত প্রাণের প্রতীক শূকপাখি উড়তে থাকে। অনেক নতুন রান্নার রেসিপির পর বান্ধবী আস্তে আস্তে শুরু করল প্রাগিতিহাসের মাতৃমূর্তির বর্ণনা। দই-জিলিপি খেতে খেতে আমি পথ ভুল করলাম।
বান্ধবীর নাম রাখলাম কৃত্তিকা। ‘কৃত্তিকা, আমরা এখন কোন নক্ষত্রে হাঁটছি?’ উত্তর না দিয়ে তেতো একটা ওষুধ আমার মুখে ঢেলে দেয় কৃত্তিকা। আমি লক্ষ্য করি ওর কপালে বারো হাজার বছরের পুরনো ছুরির দাগটা বীভৎস হাঁ করে রয়েছে। তার ভেতর আকাশটা শাদা, নক্ষত্রগুলো কালো।
জর্জ গ্যামো প্রবল বেগে সাইকেল চালিয়ে এসে আমায় থামালেন। ব্রহ্মাণ্ডের স্ফীতির অনেক রকম হিসেব কষে আমার প্রতিবিম্বটা ভাসিয়ে দিলেন যমুনার দূষিত কালো জলে। কৃত্তিকা ঋতুস্নান শেষ করে মৃগমথিত সাবান এগিয়ে দিল অন্য জন্মে।
২।
কৃত্তিকা নক্ষত্রের ধারণা ঘোলাটে হয়ে আগুন ফেলে দিল আমার পেটে। গ্রেটার কৈলাসের ছোলা-কুলচার স্বাদের ভেতর আমি ভ্যান গঘের পোড়া আঙুল আবিষ্কার করলাম। বৃষ্টি নামল। আর আমার ফিমারের হাড় ফেটে বেরিয়ে পড়ল সন্দেহ।
সন্দেহের সাথে আমি প্রথম যে বাসটায় চড়লাম তার কমলা রঙটা নন্দলাল বসুর সতীর কন্ঠনালীর মতো। বাসের ভিতর পূর্বনির্ধারিত সীটে বসে থাকা কৃত্তিকার রঙ বদলে যাচ্ছে। কৃত্তিকা হাসল। আয়ু থেকে একটা প্যালিওলিথিক ঘষাপাথরের অস্ত্র বের করল।
আমার প্রতিবিম্ব আবছা হয়ে উঠছে। কৃত্তিকার অস্তিত্বহীন সীটে পড়ে আছে আলেক্সান্ডার ফ্রীডম্যানের জটিল সমীকরণ। ক্ষয়াটে রাস্তার গন্ধে ভুল পথে হু-হু করে ছুটছে বাস ও শীতলতা। অস্তিত্বহীন আরেক অধিকারবোধে আমি ডার্ক চকোলেটে কামড় দিই।
বাস যেখানে থামল সেখানে গগনেন্দ্রনাথের অতল সিঁড়ি। আমার পায়ের শব্দে আবার পুব আকাশের বাউলরঙা আলোয় কৃত্তিকা ভাসল। ‘দ্যাখ তো, আলু-পোস্তে ঝাল ঠিক আছে কিনা?’ উত্তর দেওয়ার আগেই রক্ত চুঁইয়ে পড়ল উওর্ম গ্লেসিয়েশনে।
বরফ জমাতে জমাতে আমরা সেই শাদা ফ্লাইওভারটায় এসে পড়লাম। আর ছুরি হাতে আমাদের পথরোধ করে দাঁড়ালেন ওক্টাভিও পাজ। ‘কার চোখ নীল?’ মৃত্যুভয়ে আমরা কেঁপে উঠতেই চিৎকার করে উঠল একটা পাগল।
আমাদের অলৌকিক অস্তিত্বের ওপর দিয়ে অসংখ্য পাগল, মাতাল, ভিখিরি গল্পকে টানছে বিভিন্ন দিকে। আলোর অন্য ভিনিয়েটে অটোরিকশার ভাড়া বাড়িয়েই চলেছেন চালক। ‘খিদে পাচ্ছে তো, আর কতদূর?’ কৃত্তিকা ফোন কেটে দ্যায়।
আমি যখন গন্তব্যে পৌঁছেছি তখন কৃত্তিকা মৃত। খিদের নীচে এক বোবা কান্নায় যেসব মাংস জড়ো হচ্ছিল, তাদের মনোবিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘অভিনয়’ বলে। তবুও হাত-মুখ ধোওয়ার পর নীবার ধানের গন্ধ ছিটকে উঠল অন্ধকার থেকে।
৩।
পুনর্জন্ম হওয়াটা এখানে খুব সহজ স্বাভাবিক ব্যাপার। শুধু মৃত হরিণের চামড়া চমকে উঠল প্রাগৈতিহাসিক মৃৎপাত্রে। ন্যাশনাল মিউজিয়মের শীতল কঙ্কালের ভেতর ঢুকে পড়লাম আমরা। বাইসনের শিঙের কর্কশ পানপাত্রে চুমুক দিলাম।
কৃত্তিকা আস্তে করে টিফিনবাক্স খুলতেই মৃত্যু শেষবার দেখল আমাদের। ভারী হয়ে ওঠা এক ধাতব অস্ত্র থেকে অন্য এক অস্ত্রের আড়ালে আমরা লুকিয়ে পড়লাম। চাইনিজ খাবারের তীব্র গন্ধ তখন ঘুরপাক খাচ্ছে কনট প্লেসে।
কোল্ড কফি থেকে ছোট ছোট বুদবুদ ভেঙে কৃত্তিকা বলল ‘এখানে মিথ্যে বুদবুদের ভেতর মানুষ বেঁচে থাকে’। কতগুলো শর্ত বেঁচে থাকে। স্পেস-টাইম কার্ভেচারের ইঙ্গিতে নড়ে-চড়ে কিছু ইচ্ছের অনিচ্ছা, প্রেমের ঘৃণা। সপ্তপর্ণীর পাতায় শেষরাতের শিশিরের শব্দ হয়।
ভাঙা কাঁচের বোতল আর অজস্র নিষিদ্ধ গন্ধের ভিতর দিয়ে আমি আর কৃত্তিকা প্যালিওলিথিক পায়ের ছাপ মুছতে থাকি। অকালবৃষ্টি নামে। এইমসের দরজায় রুগ্ন মানুষের চোখে তখন কাল্পনিক ঘুম নামছে।
কৃত্তিকার হৃদস্পন্দন তখন চল্লিশে নেমে এসেছে। প্রতিবিম্বকে নষ্ট করে দিতে দিতে আমরা শহুরে খাদ্যের ভেতর থেকে বেছে ফেলছি স্বর্গ ও দুঃখের আভাস। একটা নীল রঙ কৃত্তিকার সন্তানদের নিয়ে যাচ্ছে নাচের স্কুলে।
কালপুরুষের কুকুর চিৎকার করে ওঠে পঞ্চশীল মার্গের মায়াজালে। অগণন শিশুগাছ, শিশু-উচ্চারণ রঙ মাখে শো-অফের দু’পাশে। অনুভূতিহীন একটা গতি বাড়তে থাকে শাদা কবুতরের বৃত্তাকার উড়ানে।
কৃত্তিকার সাথে আমার দেখা হল না কোনদিন। প্রতিরূপে অন্ধ শীতল পাথর ছুঁয়ে দিল শব্দের ফাঁদ, খাঁচা, জার্নিটিকিট। আবার চিৎকার করে উঠল শাদা একটা ফ্লাইওভার।
এটা কি সিরজ কবিতা? আরও পড়তে চাই... এ লেখায় গভীরতম হতে হবে পাঠককেই।
ReplyDeleteনা। একটিই লেখা, নিতান্তই ফরমায়েশী।
DeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDelete