প্রথম প্রথম নেশা
ঘুম ভাঙার একটা আলতো শব্দ হল তখন। এইসব শব্দ শুনলেই আপাতভাবে মনে হয়...কে যেন বলে উঠল, "কোথায় ছিলাম যেন..."
কিছুতেই মনে করতে পারছি না। বাড়িটার রং। মানুষটার নাম। পথের জ্যামিতি। অথচ আবছা আবছা ভাবে মিশে থাকা সব ধ্বনি। প্রতিধ্বনি। গন্ধ। প্রতিগন্ধ।
ছোটবেলার পরিচিত একজন এসেছিল। দরজা খুলতেই একরাশ ভিজে হাওয়া। চেনা কাপড়-চোপড়ের সোঁদা সোঁদা গন্ধ। যে রাস্তা সাথে নিয়ে এসেছে। তার গা থেকে লেপ্টে যাওয়া নির্লিপ্ত ল্যাভেণ্ডারের স্মৃতি। আই-টি-আই কলোনির পরিত্যক্ত জংগলের চোলাই ওম। কী যেন একটা খুঁজতে খুঁজতে উল্টো পথে তার এখানেই আসা। বারবার। মুখ দেখা যায় না। আসে। খবর নেয়। তেষ্টার কথা বলে। তার মুখে শুনি অসম্ভব পালিয়ে যাবার গল্প। এই পালিয়ে যাওয়া কখনোবা নেশা ছিল। একদিন সুপ্রভাতে যখন চেনা মানুষ ভীষণ রকম নিখোঁজ হয়ে যায়, তার চেও নির্মম সত্যি হয়ে ওঠে, খুঁজে কোনও লাভ নেই। এই। সহজ। স্বীকারোক্তি। বিকল্পহীন অজস্র জিজ্ঞাসা নিয়ে দিনরাত জাবর কাটতে কাটতে একদিন নিজের সাথে দেখা হয়। অবিকল চোয়াল মুখ। মুখোমুখি। উল্টো পা। উল্টো পথ। কারোরই আজ বলার কিছু নেই। বাইরে অসম্ভব ঝড় ক্রমশ আমাদের মধ্যেকার আলো আচ্ছন্ন করে দেয়। এরপর কী হবে... তার কোনও সংলাপ নেই
কোথায় ছিলাম যেন! কোথায় ছিলাম এতদিন। কিছুই মনে পড়ছে না কেন? মনে না পড়লে কথা বলছি কী করে? কীভাবেই বা মনে হচ্ছে, কিছু মনে নেই! একথা! কোথাও ব্যথা নেই। কোনও প্রতিবন্ধকতা নেই। অথচ স্মৃতি বলতে শুধুই ঘূর্ণি। সেই ঘূর্ণি ভেঙে ভেঙে অজস্র ঘূর্ণির রেশ। এসবের তলায় কী আছে...
যে ছেলেটি আগে কখনো ছবি আঁকেনি। অনবরত এসব ছবি আঁকে। ওর শিরায় শিরায় অসম্ভব জিজ্ঞাসাগুলো পাক খেয়ে ওঠে পেন্সিলে আর রঙে। প্রিয় রঙ। তার ফেলে আসা জামাটির কথা বলে। আই-টি-আই কলোনির নিরাভরণ দুপুর গড়িয়ে। কলকারখানার শ্রমিকদের ঘাড় হেলানো সাইকেল। তখনো ছুটির ঘণ্টা বাজেনি। একটা অদ্ভুত আকৃতি নিতে শুরু করেছে অপেক্ষা। জলপাই বেঞ্চির নরম পেরেক। অনতিদূরে কোনও অদৃশ্য অতীতের মগডালে নিশাচর এক পাখি ডেকে ওঠে। আমাদের কি ফেরা উচিত?
কতদূর! কোথা থেকে আসা। কোথায়ই বা যাওয়া। সবকিছু ভুলে মাঝে মাঝে ভীষণ প্রকট হয়ে ওঠে। একটু জলের তেষ্টা। সমস্ত পথ যেন হাওয়ায় ভাসমান। সমস্ত আলো যেন চোখ বুজে। কেউ গুলে দিয়েছে লঘু হাওয়ায়। ওরই মধ্যে একটা ঘর। না, ঘরের বিদেহী স্মৃতি। ভেসে আসে অচেনা ভাষার গান। গানের রিপিটেশান। সেই রিপিটেশানের সর্পিল পথ বেয়ে একমাত্র নাভিকুণ্ডে পড়ি। পেছল। খুব পেছল। জানালা খোলে। ফেরার হাত। ইশারায় ফিরে যেতে বলে
বা, এতকিছু মনে পড়ছে। গানের ভেতরে বসে থাকা বাদ্যযন্ত্রটিকে তুলে নিতে পারছি। এক-একটি প্রসঙ্গ অনন্ত হাঁ হয়ে আছে। একটু পরেই ফিরে আসবে সংজ্ঞা। একজন কমলা নামের মহিলা আস্ত একটা গল্প পড়ে শোনাবে। আর ক্রমশ আমরা সবাই মিলে তার ফাল্গুন পেরোনো চৈত হওয়া দেখবো। দেখবো তার অনিশ্চয় মধ্যাহ্ন পেরোনো আরো অনিশ্চয় গোধূলি। তারপর... উত্তর দেবার মত করেই সেই ভাসমান ঘরের গান থেকে একলা একলা বলে উঠবো
"কোথায় ছিলাম যেন..."
ভালো টেক্সট্। ভালো লাগল।
ReplyDelete