दहलीज़
Dahleez
A web magazine run by a group of poets from New Delhi
Editor: Pijush Biswas, Contact: poet.area@gmail.com, Mob: 9871603930 Time Spent on Page:

Sunday, March 8, 2020

রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়

ব্যথারা বিহঙ্গ হলে ভালোবাসা নাম নেয়






মৌ-কে মৌমাছির সঙ্গে মেলাতে গেলেই মৌবোনা পতঙ্গদল উড়ে আসে। অথচ কান পেতে শোনা গুনগুন কোনো ডানামেলা শব্দ নয়; ভালোবাসার গুঞ্জনধ্বনি। আমাদের আকাঙ্ক্ষার পাড়ভাঙা ইন্দ্রিয়সকল যখন শরীরের গণতন্ত্রে খুলে রাখে সর্পবেণী, মেঘজলে ধুয়ে রাখে লোভ আর লালসার খাতাসকল তখনই প্রণয়পায়ের শব্দেরা জেগে ওঠে বেহালাবাদকের ছড়ে। খুব মিহি সুর; যেন সন্ধ্যার ঘ্রাণ লাগা যুবকের আস্তিন। প্রেমের পুরোনো সিঁড়িতে মৌমাছিরা শহীদ হয়ে এলে যেসব আলোরা মৃত্যু রচনা করে সেখানে আঙুরবালার রুমালে জড়ানো দেহমেখলা; মালবিকার সূর্যস্নানের পৃষ্ঠায় ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা হরিণী রোদরোদ্বেল সিরামিকে আঁকা ছবিগুলো তখন ভিভিয়ানের আঙুল নিয়ে কথা বলে লেটুসের পাতায়। আর নীরব ঘাতকের মত রিয়ার ফেলে যাওয়া চাদরে বালিশে জড়িয়ে যায় জ্বরতপ্ত নৈঃসঙ্গ্য। অভিসারের সিঁড়িতে লেগে থাকে অলোকরশ্মি। দিনমণির সিঁথিতে দীঘল ছায়া। ছায়াদের আবর্তন শৈলীর নিচে অস্থির আঙুলের দাগ। দাগ বরাবর আইভির হাসিতে আক্রান্ত ক্ষুর রক্তাক্ত হয়ে হয়ে নৈশ জানলায় রেখে যায় রাতবার্তা। প্রত্যাবর্তনের সুর; লিডার শীতঘুমে ফাটা ঠোঁটে উড়ে আসে তীর্থযাত্রার বৈঠাকাশআমান্দার সারিগানে করিডোরে জমে ওঠে আত্মহত্যার গল্প। গল্পেরা ক্রমশঃ উড়ে যেতে থাকে এলেনের মেদুর দস্তানায়; আর ফরাসী সুগন্ধ আমাদের ইন্দ্রিয় জংশনের সমস্ত তন্ত্রগুলোয় জড়িয়ে রাখে মায়াবেণী। আমরা তখন ভালোবাসার প্রতিশব্দ খুঁজি প্রাণপণ। 

আর ক্রমশ ভালোবেসে ফেলার গুঞ্জনধ্বনি ওঠে। আহা গুঞ্জনধ্বনি। মধুকর বেয়ে বেয়ে রোয়ানো গুনগুন; রাই থেকে রমণীয় হয়ে ওঠা কখন? কোন সে মাহেন্দ্রক্ষণ? কেমন করেই বা হেঁটে যায় মসৃণ সময়ের মৌমাছিগুলো আর আমি ক্রমশই, ক্রমশ ভালোবেসে ফেলি রক্তাক্ত ঠোঁট বেয়ে ঠোঁটের নিভৃতি? গড়ানো প্রশ্নগুলো মৌ ভাঙা গুঞ্জন তুলল কবি সুকান্ত ঘোষের প্রথম কাব্যগ্রন্থ শহীদ হবার আগের মৌমাছিগুলো। পাতা ওল্টানোর আগে কিছু ভাবনা খেই ধরে দাঁড়িয়ে রইল চৌকাঠে - আমাদের এই করিডোরহীন সমাজ, যেখানে মাটি কিংবা আকাশ দুটোর একটাকে বেছে নিতে হয়; যেখানে মাটিতে পা রেখে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখাও বাতুলতা; সেখানে ভালোবাসার উপাখ্যান তো অলীক রূপকথা মাত্র। কাঁটাভাঙা সময় যখন বৃত্তাকারে হাঘর, নিতান্ত একঘেয়ে বেড়াঘেরা এই জীবনযাত্রা, সেখানে হৃদয়ের বৈশাখী ঝড়ঝাপট প্রবেশ করবে কোথায় কীভাবে? আর প্রবেশাধিকার যদি পায়ও তার জটিল অন্তর্মুখী ঘোমটা উন্মোচন করাই বা যায় কীকরে? সমস্ত প্রশ্নগুলোর সম্ভাব্য উত্তরের সম্ভাবনার দ্বারগুলো হাট খোলা করেই গড়ে উঠেছে সুকান্তর কাব্যগ্রন্থটি। প্রেমে বিশেষতঃ নারীপ্রেমে স্বাধীন ও সজীব হৃদয়ের দীপক রাগিণী শুনিয়েছেন কবিতাকেন্দ্রিক অন্তরঙ্গতা ট্রাই করে করে

আমার অবচেতনায় কবিতারা শরীরপ্রিয় হয়ে ওঠে
শরীর সূত্র মেনে চলে
এবং সূত্র শরীর মেনে চলে না
আমি তাই সমস্ত কবিতাকেন্দ্রিক অন্তরঙ্গতা ট্রাই করি
সুরেলা কম্পনে নিবিড় জলকণা ভেঙে ভেঙে
নিবিড়তা মেখে নেওয়া সেই আমি
একেলা ঘরেও রিনিঝিনি  রিনিঝিনি কেন্দ্রিক
কবিতাও ট্রাই করি        [ভিভিয়ান সেই সুরেলা কম্পনে]

পরিবর্তনশীল সম্পর্কের সঙ্গে মানবিক বিক্রিয়ায় জারিত ব্যক্তিহৃদয়ের মুহূর্তের আবেগগুলি জমাট বেঁধেছে কিছু পঙ্‌ক্তিমালায়। কোথাও বা দানা দানা প্রত্যাশায় জলকণাগুলি উপচে উঠেছে অনুভবের কিনার ধরে। জীবনের নদীসংক্রান্ত এপারে ওপারে অর্জিত অভিজ্ঞতাগুলি সংপৃক্ত হয়ে আছে কবিতায়। সেই বিস্তারে গভীর দোটানাগুলি নিবিড়ে কিছু স্পর্শ রেখে যায়; যার অবাঙ্মনসগোচর অস্তিত্ব ধীরে ধীরে কবির ভাষা আর পাঠকের বোধ এই দুই চৌকাঠে দৃশ্যমান হতে থাকে। আর তারই সঙ্গে লেপটে থাকে কবির রোমান্টিক বিষণ্ণতা। শুধুমাত্র পঙ্‌ক্তিতে নয়, দুই পঙ্‌ক্তির মধ্যবর্তী স্পেসেও জড়িয়ে যায় বিষাদনির্মিত রুয়ে দেওয়া ভাবনাগুলি

টুং শব্দে বোঝা যায় কাঁচের ভঙ্গুরতা
বিকার
অনুরণন শেষে তাই ক্ষীণ হাতে তুলে নিই টলটলে গ্লাস
আজি আর রিবিবার নেই সেই ক্যানালের ধার
সকালের
সমস্ত গ্লাসেই লেগে থাকা রাতের তলানি                [ভিজে ঠোঁটের ভিভিয়ান] 

বিষয় থেকে মুক্তি দেওয়ার যে শর্ত নতুন কবিতায়, তাতে কবি সুকান্তের নিঃসন্দেহ অধিকার ব্যক্ত হয়েছে কাব্যগ্রন্থটিতে। অবশ্যই উল্লিখিত নারীটি বিষয় কিন্তু সেই নারীকে ঘিরে যে কোলাজ সেখানে বিষয় কখনই নারীর ঠোঁটের সসেজে আবদ্ধ থাকেনি। বরং নারীর সামগ্রিক সত্তার তীক্ষ্ণ ও অনাবিষ্কৃত উপলব্ধিটুকুই প্রকাশ পেয়েছে ছত্রে ছত্রে। নারীর অবয়ব ঘিরে ছাদের আশ্রয়, দেওয়ালের সুরক্ষা আর দরজার গোপনীয়তা সমস্ত কিছুকে উপচে গেছে অলিন্দের বাতাসটুকু। আর সেই বাতাসফেরৎ স্পর্শে চীনা মেয়েটির চেনা আঙুলগুলো সবুজ স্যালাড ছুঁয়ে মেখে নেয় সিরামিক ঘ্রাণ। উত্তপ্ত সেই ঘ্রাণ থেকে দানাবাঁধা সম্পর্ক এবং তার পরিবর্তনশীলতায় সিঁড়িলব্ধ জ্ঞানের পর্যায়গুলির ইঙ্গিত আছে অথচ ভার নেই; রূপ আছে অথচ শরীর নেই; অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা আছে অথচ মোহ নেই। প্রবাসী হৃদয়ের অতৃপ্তি ও বিজনের প্রেক্ষাপটে ভালোবাসার অস্ফুট রূপ ও মাধুর্য্য কবিতার সমস্ত শরীর জুড়ে

আমাদের সমস্ত ঘটনায় সিঁড়ি
আমরা কাঠের বাড়িতে থাকি
সেই সিঁড়িলব্ধ জ্ঞানের প্রথমটায়
কেউ কাঁধে মাথা রেখে কাঁদলে আমি
ধর্মগ্রন্থের মতই ভাগ্যবান হয়ে যাই কিংবা উভয়েই

একথা জানতেই না ভিভিয়ান এবং আঙটি
রূপার গায়ে লেগে আছে অচেনা অক্ষরে
সিঁড়িলব্ধ জ্ঞানের দ্বিতীয় ভাগটা        [কাঠের বাড়িতে ভিভিয়ান]
নিঃসঙ্গকে ভেঙে দুটুকরো করলে সঙ্গ আর নেই পাশাপাশি। চিলেকোঠা আকাশ আর রিয়ার রেখে যাওয়া গোলাপী চাদরে নির্জন বিসর্গ নিবিড়ে সিরসির। শব্দের সঙ্গীতে বিরহ মধুর হল একান্ত পূর্ণিমায়; যখন অযাচিত সন্ধ্যা নামছে, অলিন্দে হিমসিক্ততা, তখন কবির সহজাত অথচ পূর্ণগর্ভ নৈঃসঙ্গ্যই মূর্ত হয়ে ওঠে কবিতার অস্ফুট পঙ্‌ক্তিমালায়। শব্দের বিন্যাসে অনুভবের ক্রমপরিণামী স্তরগুলি ঘিরে ফুটে ওঠে রেখা; ধীরে ধীরে গাঢ় হয় রঙ; দৃষ্টির সীমানায় জেগে ওঠে কল্পপথের লাবণ্য যার কেন্দ্রে অবস্থান করে নির্জনতা ও নৈঃসঙ্গ্যের অনির্বচনীয় সঙ্কেত-

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মেয়েরা আমাদের অজানতেই গোলাপী রঙে প্রীত হয়
রিয়া ফ্রান্স বেড়াতে যাবার আগে তার এমনি গোলাপী চাদর
আমার ঘরে রেখে যায় এবং বালিশ ও
ফলতঃ আমি এখন জ্বরতপ্ত কিন্তু নিঃসঙ্গ নই
আমার জামায় গোলাপী সুবাস যারা পেতে পারে
তারা এভাবেই বুঝে যায় আমি নিঃসঙ্গ
আর জ্বরতপ্ত হই
চিলেকোঠা আকাশে ভিজে পতঙ্গের
এয়ার ফ্রান্সের অযাচিত প্রতীক্ষা       [রিয়া কাল ফিরে আসবে বলেছিল]

কবি সুকান্তের কবিতায় যৌনচেতনা তীক্ষ্ণ মনননির্ভর। তাই যৌনাঙ্গ চিহ্নিত শব্দের প্রয়োগ কখনও যৌনচেতনায় ব্যাঘাত ঘটায় না। কারণ তার সূক্ষ্ম সাংকেতিকতা, শৈল্পিক ইশারা এবং ইঙ্গিতময় চিত্রকল্পের উপস্থিতি। কাব্যগ্রন্থটির সূচনাগদ্যে কবি আর্যনীল মুখোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন,
ভালোবাসার অভিজ্ঞানগুলো সব ঠিকঠাকই আছে। আছে গোলাপ, গহনা, পাখি, রক্ত, অন্তর্বাস, যেমনটা থেকে থাকে। কেবল তারা তাদের প্রত্যাশিত ক্ষণে নেই, খানে নেই”।

চেনা ভালোবাসার চেনা ব্যাকরণের বাইরে কবি যে রহস্যপ্রকৃতির সাতসমুদ্র নির্মাণ করেন সেখানে উঁকি দিলে দেখা যায় যৌন উপত্যকায় কিছু পাখির উড়ান। নিঃস্বর তন্ত্রীতে মৃদু সুর যার আরোহ অবরোহ বেয়ে আপনি পৌঁছে যাবেন সেই তাইওয়ানিজ মেয়েটি, নাম যার আইভি, তার প্রতিটা রাতের নির্ঝর হাসিউপকূলে

ঠিক নিচের ঘরটায় তুমি নূপুর খুলতে থাকো
ডান পা দিয়ে অবিরাম দক্ষতায়
একটা পায়েই দুলতে থাকা মোজার উপরে   [যে ভাবে হাসে আইভি]

কিংবা পাশের রুমের লিডা মানে পারসিক মেয়েটির পারস্যদেশ ছুঁয়ে থাকা সিরাজিও ঠোঁটে
 
যৌথ স্নানঘরে চেনা সুবাস, ভুলে আসা অন্তর্বাসে
নিজেকে নিষিক্ত মনে হয়
অথচ আমি চিত্রকর নই
তা জেনেও তুমি সিক্ত হয়ে যাও
কাঠের দেওয়ালের ওপাশে

আমার চারপাশে তখন শীতঘুম ফাটা ঠোঁটেদের...        [লিডা একটি পারসিক নাম]


শব্দেরা মৃত। গালের ফেনার ভেতর ক্ষুরের অভিজ্ঞতার স্মৃতিকে নিয়ে কবি যখন সেই অস্তিত্বের স্তরগুলিতে ঢুকে যান তখন এক একটি শব্দের ভেতর কবি তাঁর সমগ্র সত্তার আলোড়ন ও সংক্ষোভকে সংহত করে তোলেন। ফলে অর্থের অবয়বে আসে অর্থাতিরিক্তের দোলা -  

ক্ষুরটা আরো গভীরে যায়
ফিতেরা সেই ফাঁকে সরে যেতে ভালোবাসে
ছোট জিবে লাগা পর্কের স্যূপ
মসৃণ দাঁতের ফাঁক দিয়ে খেলা করে    [যে ভাবে হাসে আইভি]

কিংবা সেই আমান্দা নামে মেয়েটি, যেখানে আত্মহত্যার গল্প জমাট বাঁধে, সারিগান বুনে যায় মুহূর্ত, যে সারিতে কবির শুক হতে চাওয়া, আবার সারিও অর্থের ইঙ্গিতে শব্দের অবয়বে কোনো দূর দিগন্তের বৈচিত্রের আভাস লুটোপুটি খায় আমাদের বোধের অঙ্গণে, 

তুমি খোঁজ সারিগান আমি গান-সারি
প্রলম্বিত কিছু শব্দের ছায়া চেনা করিডোরে
ওখানেই রেখেছি আমার চুমুক
আমারই ঠোঁটের দাগ
আনার পিপাসা        [আমান্দা-কে দেখছি করিডোরে]


কবি সুকান্ত ঘোষের কাব্যগ্রন্থ এক পৃথিবী পরিক্রমার কাহিনী। তবু সে কাহিনী পায়ে পায়ে সচলতার ভ্রমণকাহিনী নয়; বরং বলা যায় মানসযাত্রা; যেখানে মননের ধার ঘেঁষে অনুভবি পরিক্রমা। সে কাহিনীতে বহু দেশ বহু সমাজের চালচিত্র প্রেক্ষাপট রচনা করলেও সেখানে রচয়িতা কেবল নারী। মাটি মানেই নারী। সেই অদেখা অচেনা দেশটির মাটি আর সেই মাটির ওপর পরম্পরা বেয়ে যে সমাজটি দেওয়াল আর ছাদের ফাঁকটুকু জুড়ে নিরেট রমণীয়তায় বাসা বাঁধে, তার কেন্দ্রে থাকে নারী। কখনও সেই নারীর গোপন ডানায় হাত রেখে, কখন বা দীঘল চোখের কোলভাঙা পালকে মুখ ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিতে নিতে কবির যাত্রা। কখনও সেপথে দেখা হয়ে যায় সিম্ফনি হলের মেদুর দস্তানাশোভিত কারমেনের সঙ্গে। কিংবা সাজানো গার্ডেনে নিয়মিত অগোছালো বিকেল আনতে গিয়ে জানা হয়ে যায় টোমোয়ো-কে, প্রায় জাপানি মেয়ের মতই টোমোয়ো মসৃণ রূপোর গহনা ভালোবাসে প্রতিটি অঙ্গে। কখনও বা ডান্সফ্লোরের মোহময়ী আলেকজান্দ্রাকে ঘিরে উত্তর-না-মেলা প্রশ্নের উঁকিঝুঁকি

তুমি কি শাড়ি ভালোবাস, জটিলতা?
তুমি কি পাখি ভালোবাস বেদনা?
যাদের কাজল আছে
আমার চোখে তারা রামধনু
জানি তুমি বৃষ্টি ভালোবাস, কুয়াশা!         [ডান্সফ্লোরে আলেকজান্দ্রা]

কবির কোনো বধিরতা নেই। তাই তো তিনি সাড়া দিতে পারেন চলপথের উঁচুনিচু অনুভূতির পরিক্রমায়; সাড়া দিতে পারেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সকল প্রকার স্পন্দনে। আপন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে এই সচেতনতাই তাঁর প্রকাশমাধ্যম। কবি বলেন

আমার ক্ষয়িষ্ণু ভাবনাগুলি প্রায়শই সৌন্দর্য্য কেন্দ্রিক অনুভূতির সমান্তরালে প্রবাহিত হয় সেখানে আকর্ষণ আছে, কিছু বর্ষাস্নাত দুপুরে খুনসুটি আর স্বচ্ছ অথচ নির্জন সন্ধ্যায় রোমন্থন”।

এই রোমন্থনের পথ ধরেই আমরা এগিয়ে চলি অনুভবের ইতিবৃত্তে। হোক সে আপাত সত্যের উপাখ্যান বা অভিজ্ঞতার অভিঘাতজনিত ক্রিয়া বিক্রিয়ার পথ ধরে কল্পলোকে ডানা মেলার উপাখ্যান আমরা শুধু বুঁদ হয়ে থাকি পরবর্তী শব্দচেতনার প্রেক্ষাপটে নির্মিত রহস্যে হৃতমান যুবকের সাথে

রোদ্দুর ঘনায়ে এলে আমি হৃতমান
ছাতা সরানো রুফটপে
বিকিনি মেলে দেওয়া প্রতিবেশী
যে বইটি উল্টাতে থাকে
তা আমার পড়া ছিল কোনকালে
হয়ত     সে এক লাজুকতায়
দুপুর হারায়ে যেমন
রৌদ্রস্নাত স্তনগুলিরাতের খাবার ভুলায়
নিয়মিত শনিবারে মায়া সভ্যতার গহনায়
আর সেই পোষাকে
ওকে এয়ালিস চিনি ডাকানামে
কারণ পোষ্টম্যান জানে শুধু ফ্ল্যাটের নাম্বার           [এক হৃতমান যিবিকের সাথে]


অনুভূতি পরিক্রমায় একের পর এক পেরিয়ে আসি ওয়াইন রোডে কাঠের ওপর ক্লান্তি ঘষে নেওয়া খালি পায়ের আঙুরবালা, সালসা নাচের নিয়মিত ক্লাসে সিসিলীয় দ্বীপের আনা, রিজার্ভ ফরেষ্টে চিড়িয়া লাইনে দাঁড়ানো স্মৃতিমেদুর অনুপমা এভাবেই চলতে চলতে থমকে যাই দ্বিতীয় পরিচ্ছদের শেষ কবিতায়

আঁধার এলে শুরু হয় চুমুকের শব্দ বা জিহ্বার
এমনি সময়ে কেন মনে হয়
চার বছর তুমি লেসবিয়ান ছিলে!
আমি এমনি কবিতা ভেবে চলি প্রিয়তমা
প্রতিটি প্রিয়তমা কবিতা হয়ে
অজস্র না-খোলা চিঠির ফুটে ওঠা কালিতে
মুহূর্ত হয়ে যায় জেনে
সমস্ত কিশোরীই ভালোবাসে নিজেদের
শুধু ওদের ভালোবাসার প্রতিশব্দ হয় না  [ফন একদা লেসবিয়ান ছিল]
 
আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী সেই কবে থেকেই যেন কবিতা সুন্দরী, কবিতা নারী। আমাদের মননের চারপাশ ঘিরে মানসীর অন্তর্লীন অবস্থান। সেই কবিতা আর সৌন্দর্য ও বিষণ্ণতার আশ্লেষে সুকান্তের নারীকে ভাবা কবিতা এই দুই নারীর পারস্পরিক সম্পর্ক হাতড়ে লেসবিয়ান প্রশ্নটি ঘুরপাক খেতে থাকে সূচনাগদ্য থেকেই। নগ্ন নির্জন চোখে কাব্যগ্রন্থের পাতা ওল্টালে আপনিও হয়ত খুঁজে পাবেন বহু সম্পর্কের নিবিড় যাপন। এ দুটি মেয়ের আঁচলের রঙদার বুটিকে মুখ ডুবিয়ে দেখুন পেলেও পেতে পারেন আপনার আকাঙ্ক্ষিত সেই আকাশ, যা আধুনিক জীবনের অধিকতর জটিলতার  চ্যালেঞ্জকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ তার আবরণ ছাড়িয়ে গিয়েও অনেকটা আভরণ। যার ঝলকে ওঠা দ্যুতি থেকে দ্যুলোকবিহার। যেন একটা Gateway. দরজার ভেতর আর এক দরজা। যেন বন্ধ দরজা। কী আছে ওইপারে? নাভিমূলের গোপন রহস্যে? দরজা খুলে ঢুকে পড়ি শব্দমায়ায়। গুটিকয় শব্দের নিচে এক অসীম অনন্ততাকে ধরা যায় না। তাকে স্পর্শ করা যায় না সেখানে নারী কেবল তার রূপ থেকে অরূপে ফিরে ফিরে আসেচেতনার এমনই এক স্তরে সে বিরাজ করে যেখানে মান নেই, অভিমান নেই, শোক নেই, দুঃখ নেই, নেই কোনো মৃত্যুর স্পর্শআছে শুধু আলো আর আলোআর সেই আলোয় চিনে নিই মুহূর্তগুলোর মুক্তোমালায় জড়িয়ে থাকা অজস্র্য নারীমুখ। এভাবেই ঘোরে ও বেঘোরে পৌঁছে যাওয়া শেষ পাতায়। যেখানে বোধের আলোয় দেখা নারীমুখগুলি হঠাৎই ক্যামেরার চোখ নিয়ে আলোকচিত্রিত। আমি তো মেলাতে চাইনি। বরং কল্পনার ডানায় মুখ ডুবিয়ে উড়ে যেতে চেয়েছিলাম। শেষে এসে ডানাটুকু ছেঁটে দেবার অভিমানে অন্তরা ভেঙে ভেঙে যায়। তবু এই ভাঙাটাই শেষ কথা নয়। ব্যথারা বিহঙ্গ হলে ভালোবাসা নাম নেয় - তারই ভ্রূণসংকেত রেখে যায় কবি সুকান্ত ঘোষের কাব্যগ্রন্থ।         

যেখান থেকে শুরু এই গুঞ্জনধ্বনি তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচয়:

কবি: সুকান্ত ঘোষ



জন্ম ১৯৭৮ সালে, পড়াশোনা কলকাতা ও ইউকে থেকে, ও পেশায় রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার। পিএইচডি করেন মেটিরিয়াল ও মেটালার্জি নিয়ে এবং আমস্টারডামে Shell’s Research and Technology Centre তে কর্মরত। বিভিন্ন ওয়েবজিনে লেখালেখির শুরু ২০০০ সালে, যার মধ্যে আছে কবিতা, গদ্য, নাটক, ভ্রমণকাহিনী। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “শহীদ হবার আগের মৌমাছিগুলো” প্রকাশিত হয় কৌরব প্রকাশনী থেকে ২০০৮ সালে, প্রচ্ছদ: সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়

1 comment:

  1. বা! বেশ ভালো আলোচনা হয়েছে। আলোচক কবি সম্পর্কে একটা আগ্রহ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছেন। এটাই গতিমুখ হওয়া দরকার।

    ReplyDelete

সম্পাদকীয়

পীযূষকান্তি বিশ্বাস দেহলিজ ফিরেছে পঞ্চম সংখ্যা হয়ে । দিল্লির নিজস্ব রঙে । ফিরে এসেছে ভাইরাস আর প্রতিহিংসার প্রচ্ছদে । তার উপরে এমন এক...